অপেক্ষাকৃত কম-ঝুঁকির সঞ্চয় – ডেট ফাণ্ড

একটু রাতের-দিকে-ঝোঁকা সন্ধ্যেয় চিরকালের অভ্যাসমতই বই নিয়ে বসে ছিল সুমি। এমন সময় ফোন। সচরাচর এই সময়ে কেউ ফোন করে না। একটু কৌতুহলী হয়ে ফোনটা তুলে নিল।

“সুমিদি ব্যস্ত? যদি ফাঁকা থাক, তাহলে একবার তোমার কাছে যাব? একটা প্রশ্ন আছে।“  – অন্তরা জানতে চাইল। অন্তরা সুমির প্রতিবেশিনী।

“না ব্যস্ত নই মোটেই। চলে আসতে পারিস ।“

একটু পরেই দরজায় কলিংবেলের শব্দ। এবং অন্তরার প্রবেশ। বলতে বলতেই ঢুকল ,” সুমিদি চা খাব। একটা ম্যাগনাম কাপে করে। আর সেই সঙ্গে আলুর চপ – এই যে, ঠোঙ্গাটা ধর।  তোমার ভাগে দুটো, আমার ভাগে দুটো। “

এই স্বতঃস্ফুরততার জন্যেই মেয়েটাকে মনে মনে পছন্দ করে সুমি। ঠোঙ্গাটা নিতে নিতে বলল, “চা বসিয়েই দিয়েছিলাম তুই আসবি বলতেই । কিন্তু তুই এখন ফিরলি অফিস থেকে? বাড়ী যাস নি এখনো?”

“নাঃ তোমার থেকে জ্ঞান নিতে এসেছি – একেবারে জ্ঞানসাগরে স্নান করে ফিরব বাড়ি! “

এই বার হেসে ফেলে সুমি। “ ইয়ারকি হচ্ছে? তোকে কিচ্ছু বলব না! ” – চায়ের কাপ হাতে ধরাতে ধরাতে বলে সুমি।  দুজনে চা, আলুর চপ নিয়ে গুছিয়ে বসলে অন্তরা শুরু করে। “সমস্যাটা হল এই যে, পিকলুর পড়াশোনার জন্য আমার একটা রেকারিং করা ছিল – তো সেটা ম্যাচিওর করেছে। অথচ টাকাটা লাগবে বছর চারেক পরে। সায়ন বলছিল, এফডি করে দিতে। কিন্তু এফ ডি করলে তো আবার সুদের উপর অনেক ট্যাক্সও দিতে হবে। তাই তোমার কাছে এলাম। এমন কোন ঊপায় আছে যাতে সুদও পাওয়া যাবে, আবার ট্যাক্সও দিতে হবে না? আর একটা কথা, কোন রিস্ক নিতে পারব না কিন্তু – টাকা হাওয়া হয়ে গেলে ছেলের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাবে।”

images

“কঠিন সমস্যায় ফেললি দেখছি। শোন রিস্ক ছাড়া রিটার্ন পাবি না।  এ কিন্তু একদম সাপলুডো খেলা – তোর কাজ হচ্ছে বুদ্ধি খাটিয়ে সাপকে না ঘঁটিয়ে মই ধরার চেষ্টা করা। মই না পাও ক্ষতি নেই তত, শুধু সাপের মুখে পড়ো না।  আর ট্যাক্স দিতে হবে না, এমনও কিছু নেই। তবে যেহেতু তোর সময়সীমাটা তিন বছরের বেশী, তাই তুই অল্প রিস্ক নিয়ে  ডেট মিউচ্যুয়াল ফান্ডের কথা ভাবতে পারিস। তিন বছর পরে তুই সেখানে লং টার্ম ক্যাপিটাল গেইনে ইনডেক্সেসনের সুবিধা পাবি, তাই ২০% হারে কর দিতে হলেও, করের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম-ই হবে। রিস্ক কিন্তু থাকবেই সেটা মনে রাখিস। ”

“কি রকমের রিস্ক বলত?”

“ডেট মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলো মুলতঃ দুভাবে টাকা বাড়ানোর চেষ্টা করে। প্রথমতঃ এমন কোন কোম্পানিতে টাকা ঢালল, যার ক্রেডিট রেটিং নীচু। আশা করল যে ওঁদের ক্রেডিট রেটিং ভবিষ্যতে বাড়বে, তখন কোম্পানীর সব ঋণপত্রেরও দাম হু হু করে বেড়ে যাবে। কিন্তু কোন কারণে সেটা হল না, বা আরও খারাপ যেটা যে রেটিং আরও পড়ে গেল তখন দাম তো বাড়লই না উল্টে কমেও যেতে পারে। এছাড়াও কোম্পানি ধর সুদ দিতে পারল না বা ধর এমনকি আসলও ফেরত দিল না-  একে বলে ক্রেডিট রিস্ক।

আর একটা রিস্ক হল ইন্টারেস্ট রিস্ক। বাজারে যখন টাকা ধারের ক্ষেত্রে দেয় সুদের হার বাড়ে,  তখন বন্ডের দাম কমে। আরেকটু বুঝিয়ে বলি। ধরা যাক যখন বাজারে ৫% সুদের হার, তখন তুই ১০০ টাকা দিয়ে একটা বন্ড কিনলি। তুই বছর বছর তার থেকে ৫ টাকা করে পাবি।  এবার একবছর বাদে ধরা যাক সুদের হার বেড়ে ৭% হল। তখন বাজারে যে নতুন বন্ড সেগুলো কিনলে লোকেরা ৫ টাকার জায়গায় ৭ টাকা করে পাবে বছরে। তাই সবাই তখন নতুন বন্ড কিনতে চাইবে, তোরটা কেউই কিনতে চাইবে না। ফলে চাহিদা না থাকায় তোর বন্ডের দাম ১০০ টাকার থেকে কমে ধর ৯৭ টাকা হয়ে গেল। সেক্ষেত্রে তোর পুরো লস।  উল্টোদিকে এক বছর পরে যদি সুদের হার কমে ৪% হয়ে যায়, তখন কিন্তু আবার সবাই তোর বন্ডটাই কিনতে চাইবে – চাহিদা বাড়ায় তারও দাম বেড়ে ধর ১০৪ টাকা হয়ে গেল। তোর লাভও বাড়ল। একে বলে ইন্টারেস্ট রিস্ক।  এছাড়াও হাজার গন্ডা রিস্ক আছে আছে – তবে এই দুটো খুব বড় ধরণের কমন রিস্ক। ”

“এ তো দেখছি জ্যোতিষীর সাহায্য নিতে হবে – ভবিষ্যত গণনা করিয়ে তবে ইনভেস্ট করব বলছ? ”

“ভালো বললি এটা” – হেসে ফেলে বলে সুমি। “তবে যতদিন না তেমন জ্যোতিষী মিলছে, ততদিন একটু কোথায় ইনভেস্ট করছিস তারা কেমন ধরণের কোম্পানিতে টাকা ঢালবে, সেটা দেখে নিয়ে টাকা দিলেই খুব একটা অসুবিধা হওয়ার কথা না। AAA বা AA+ এই ধরণের ঋণপত্রে ভয় কম।  এ জন্য বন্ডের  আর সুদের হার কোন দিকে যাচ্ছে সেটাও একটু চোখ কান খোলা রাখলে জানাই যায়। যেমন এখন একটু বাড়তির দিকে। হয়ত ঠিক ঠাক বৃষ্টি হলে, ফসল ভাল হলে, এখনই খুব বেশি নাও বাড়তে পারে। তবু সতর্ক থাকা ভালো। এই সময়ে খুব দীর্ঘমেয়াদী বন্ডে ইনভেস্ট না করাই ভাল। স্বল্পমেয়াদী যেমন আলট্রা শর্ট টার্ম ফান্ড এই পরিস্থিতিতে ভালো।

বিজ্ঞজনেরা আরেকটা কথা বলেন যে গত পাঁচ সাত বছরের ১০-বছরের জি-সেক বন্ডের গড় yield কি সেটা দেখা উচিত। গত সাত বছরের উপর বন্ডের গড় yield ছিল ৭.৮২৯% আর এখনকার yield  মোটামুটি ৭.৭৭২%। এরকম ক্ষেত্রে নাকি বেশি সম্ভাবনা সুদের হার ( yield ) বেড়ে বেড়ে গড় yield এর দিকে যাবে।  সেক্ষেত্রে বন্ডের দাম কমবে। তাই আপাততঃ দীর্ঘমেয়াদী বন্ডের থেকে দূরে থাকাই ভালো।

আর সবথেকে বেশি দরকার যে কোন ফান্ডে ইনভেস্ট করার আগে তার স্কিম ইনফরমেসন ডকুমেন্টটি ভালো করে পড়া। ফান্ড কিধরণের কাগজে  কিভাবে কি অনুপাতে টাকা ঢালবে সেটার সম্বন্ধে একটা স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যাবে ওখান থেকেই।  এছাড়াও দেখা দরকার yield to maturity,  এক্সপেন্স রেশিও, কত টাকা ফান্ডে খাটছে ইত্যাদি।  ফান্ড ম্যানেজার কেমন মানে তার ট্র্যাক রেকর্ড কেমন, ফান্ডেরও ট্র্যাক রেকর্ড কেমন এগুলোও দেখে নেওয়া ভাল।  আর বিশেষ করে দেখবি ফান্ডটা কোন ক্যাটেগরিতে পড়ছে। সেবি সম্প্রতি ফান্ডের ক্যাটেগরাইজেসনে অনেক বদল এনেছে জানিস তো। অনেকগুলো ক্যাটেগরিই মাক্যাওলে ডিউরেসনের ভিত্তিতে করা।”

“দাঁড়াও দাঁড়াও এই ম্যাকাওলে ডিউরেসনটা কি জিনিস? উচ্চারণ টা ম্যাকাওলে?”

“উচ্চারণ টা আমিও ঠিক জানি না রে। Frederick Macaulay র না এটা একটা বন্ডের বাজারের স্ট্যাটিস্টিক্স। ধর তুই ১০০ টাকা দিয়ে  একটা ৫ বছরের ম্যাচুওরিটির বন্ড কিনলি যেটা বছরে ৭.৫% সুদ দেয় আর সেটা দেয় বছরে দুবার। এবার এই যে বছরে বছরে তুই টাকা পাচ্ছিস, তাহলে কতদিন বন্ডটা ধরে রাখলে বন্ডের দাম আর বন্ডের থেকে সময় –সময় প্রাপ্তব্য অর্থের আজকের দিনের মোট  যোগফল বরাবর হবে।  যে বন্ডটার কথা বললাম তার ক্ষেত্রে এই সময়টা ৪.২৬ বছর।”

“এত অঙ্ক বুঝতে চাই না। কিন্তু তুমি একটু সেবির ক্যাটেগরিগুলো বলবে? ”

“ওপেন এন্ডেড ডেট ফান্ডের জন্য সেবি ১৬ টা ক্যাটেগরি বলেছে। সব কটার কথা এখন বলছি না – পরে কখনো হবে। তবে তার মধ্যে ছটা হল এই ম্যাকাওলে ডিউরেসনের ভিত্তিতে। ম্যাকাওলে ডিউরেসন ৩ থেকে ৬ মাস হলে তার ক্যাটেগরি আলট্রা শর্ট ডিউরেসন ফাণ্ড,  ৬ থেকে ১২ মাস হলে লো ডিউরেসন ফাণ্ড, ১ থেকে ৩ বছর হলে শর্ট ডিউরেসন ফাণ্ড, ৩ থেকে ৪ বছর হলে মিডিয়াম ডিউরেসন ফাণ্ড, ৪ থেকে ৭ বছর হলে মিডিয়াম টু লং ডিউরেসন ফাণ্ড আর ৭  বছরের বেশি হলে সেই ক্যাটেগরির নাম লং ডিউরেসন ফাণ্ড। ”

“এই আলোচনাটা আজ এখানেই থাক। আমাকে বাড়ি গিয়ে রান্না বসাতে হবে। আজকের জন্য আমি তাহলে বাড়ি গিয়ে খুঁজব আলট্রা শর্ট ডিউরেসন ফাণ্ড কোনটা বেশ পছন্দ হয়। গোটা তিনেক বেছে বুছে তারপর আবার আসব কদিন পরে – তখন বাকী আলোচনা টা শেষ করব। ”

 

Disclaimer – মতামত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার থেকে বলা। ব্লগারের এ বিষয়ে কোন professional  যোগ্যতা নেই।

তথ্যঃ

https://in.investing.com/rates-bonds/india-10-year-bond-yield-historical-data

https://www.sebi.gov.in/legal/circulars/oct-2017/categorization-and-rationalization-of-mutual-fund-schemes_36199.html

One thought on “অপেক্ষাকৃত কম-ঝুঁকির সঞ্চয় – ডেট ফাণ্ড

Leave a comment